আমার হাসবেন্ড বেশ কিছুদিন ধরে এই গ্রপে “কানাডায় নয় মাসঃ আমাদের অভিজ্ঞতা” শেয়ার করছে। তার লেখাগুলোর প্রেক্ষিতে পোষ্টে বা ইনবক্সে অনেক প্রশ্ন পাই দুজনেই। আমাদের স্বল্প জ্ঞানে আর অভিজ্ঞতায় যতটুকু সম্ভব আমরা উত্তর দেয়ারও চেষ্টা করি। তবু কিছু কিছু কমন প্রশ্ন আছে যা অনেকেই করে থাকেন। আমার এই পোষ্টে আমি সেই প্রশ্নগুলো নিয়ে কিছুটা আলোচনা করতে চাই।
প্রথমেই ডিসক্লেইমারঃ “এখানে আমি যা যা লিখছি তা আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা; কিছু ঠেকে শিখেছি, কিছু দেখে। সবটাই সবার জন্য পারফেক্ট হবে তা নয়, তাই আপনার নিজস্ব জ্ঞানবুদ্ধির প্রয়োগ বাঞ্ছনীয়”।
প্রশ্ন ০১: আমি বাংলাদেশে ভাল জব করি। ইনকামও মাশাল্লাহ ভাল। আমার কি কানাডা যাওয়া উচিত হবে?
উত্তরঃ ভাই এবং বোনেরা, আপনারা নিজেরাও জানেন যে এই প্রশ্নের জবাব দেয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। আপনার নিজস্ব লাইফস্টাইল, কেরিয়ার, ফ্যামিলি সহ আরো অনেক বিষয় ইমিগ্রেশন ডিসিশানে গূরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দেশে আপনি যতই ভাল জব করেন না কেন, এখানে আসবেন শূন্য হাতে। আবার নতুন করে শুরু করবেন সবকিছু। এই নতুন জীবন একটা নতুন কেনা খাতার মত, যাতে আপনি আবার নতুন করে জীবনের গল্প লিখবেন। কারো গল্প হয়ত রুপকথার মত সুন্দর হবে, কারো হয়ত মাঝামাঝি, আবার কারো হবে উল্টোটা।
আমাদের নিজেদের কথাই বলি, আমাদের প্লেন যখন ঢাকা এয়ারপোর্টের রানওয়েতে চলতে শুরু করল, তখন হঠাতই এক অজানা আতঙ্ক আমাদের দুজনকেই তীব্রভাবে গ্রাস করল। নিজেদের অজানা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে একটা ভয় ঢুকে গেল মনের মধ্যে, শুধু নিজেরা তো নই, সাথে যে ২ বছরের ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছি তাকে আদৌ সুন্দর ভবিষ্যত দিতে পারব কিনা, সেই আশঙ্কায়!
তবে আমার মতে ইমিগ্রেশন যদি করতে চান, তবে যত ইয়ং বয়সে আসবেন ততই ভাল। তাতে ক্যারিয়ার নতুন করে শুরু করলেও হারানোর কষ্ট কম হবে। আমরা দুজনেই আমাদের ৫ বছরের ক্যারিয়ার পেছনে ফেলে এসেছি, এখানে এসে নতুন করে শুরু করেছি। কিন্তু কিছু হারিয়েছি বলে মনে হয়না। আমাদেরই পরিচিত এক দেশী ভাই আছে, তিনিও দেশে ব্যাংকেই জব করতেন, আমাদের তুলনায় অনেকটা উপরের পজিশনে। সেই ব্যক্তি যখন কানাডায় এসে আমাদের লেভেলে জব শুরু করলেন, তখন তার মধ্যে অনেকটা হতাশা আমরা নিজেরাই টের পেয়েছি!!
প্রশ্ন ০২: কানাডায় জব প্রসপেক্ট কেমন?/ আমি কি ধরনের জব পাবো?
উত্তরঃ এইবার আসেন, আসল প্রশ্নে!
জবের ব্যাপারে আমি একটা কথাই বলব, যদি আপনার যোগ্যতা থাকে, আর আপনি আসলেই স্কিল্ড হন তবে আপনার জব না হওয়ার কোন কারন নেই। অনেকেই আমাদের কাছে বিভিন্ন সেক্টরের জব এভেইলেবিলিটির ব্যাপারে জানতে চান, তাদের প্রতি আমার একটাই অনুরোধ, নিজেরা রিসার্চ করেন। এখন প্রশ্ন করতে পারেন, কিভাবে রিসার্চ করব? কোথা থেকে শুরু করব? আসেন, এই ব্যাপারে কিছু আলোকপাত করি।
টিপস ১- জব সার্চঃ indeed.com এটা একটা অনলাইন জব সার্চ ওয়েবসাইট। এবং কানাডার জব মার্কেটে পপুলার জব সাইটগুলোর মধ্যে অন্যতম। আপনার কোন ধরনের জব দরকার সেটা আন্দাজ করে সার্চ শুরু করুন। অনেক জব সার্কুলার পাবেন। সার্কুলারগুলো মনোযোগ সহকারে পড়ুন, খেয়াল করুন তারা কি চাচ্ছে। আপনার জব এক্সপিরিয়েন্সের সাথে যায় কিনা দেখুন। আর দেখুন এর জন্য তারা কোন কোর্স বা সার্টিফিকেশন চাচ্ছে কিনা। যদি সম্ভব হয়, সেই সার্টিফিকেশন দেশে থাকতেই করে ফেলুন।
উদাহরনস্বরুপঃ কানাডায় ফাইনান্সিয়াল ইন্ডাস্ট্রিতে বর্তমানে এন্টি মানি লন্ডারিং –এর খুব ডিমান্ড। এবং এই রিলেটেড জবের জন্য ক্যামস /এক্যামস সার্টিফিকেশন খুব জরুরি। এখন আপনি যদি এই লাইনের লোক হন, যদি জব টাইটেল ঠিক করতে পারেন আর যদি এক্যামস থাকে, তাহলে আপনি একটা না, কয়েকটা জব পেয়ে যাবেন একসাথেই।
টিপস ২: স্যালারি কেমন পাবো?
Glassdoor.com এ যান। যেই জবকে আপনি টার্গেট করেছেন, সেটার ব্যাপারে সার্চ করুন। স্যালারি, ইন্টারভিউ প্রসেস, ইন্টারভিউ কোয়েশ্চেন ইত্যাদি সম্পর্কে ভাল আইডিয়া পেয়ে যাবেন।
টিপস ৩ – LinkedIn
LinkedIn এর নাম নিশ্চই শুনেছেন। যত তাড়াতাড়ি পারেন লিংকডিনে একাউন্ট খুলে ফেলুন, আর যদি লিংকডইন প্রিমিয়াম একাউন্ট খুলতে পারেন তাহলে তো আরো ভাল, কিন্তু এর ফি টা অনেক বেশি।
এবার আপনি যেই জবকে টার্গেট করেছেন কানাডাতে সেই জব করছে এমন কাউকে খুজে বের করুন। প্রথমে দেশি লোকজনকেই খুঁজুন। এড রিকোয়েস্ট পাঠান। তাদের সাথে নেটওয়ার্কিং শুরু করুন। জানার চেষ্টা করুন, কিভাবে নিজেকে তৈরি করলে আপনি জব পাবেন।
ও, আরেকটা প্রশ্ন, লিংকডইন প্রোফাইল কিভাবে ক্রিয়েট করবেন? আর প্রোফাইলে কি লিখবেন? অন্যদের প্রোফাইল দেখুন। কয়েকটা দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন যে কিভাবে কি লিখতে হবে, অবশ্যই কানাডায় যারা জব করছে তাদের প্রোফাইল ফলো করবেন এই ক্ষেত্রে।
“কানাডাতে ৮০% জব হয় নেটওয়ার্কিং এর ভিত্তিতে, এই কথাটা সত্যি। এমনকি যেই জব আপনি ইন্টারভিউ দিয়ে পাবেন, সেটাও এক ধরনের নেটওয়ার্কিং।“
এখানে প্রায় প্রতিটি কোম্পানিতেই জব এর ব্যাপারে তাদের এমপ্লয়িদের ইন্টারনাল রেফারাল আগে প্রেফারেন্স পায়, তারপরে অনলাইন এপ্লিকেন্টরা। তাই আপনি যদি নেটওয়ার্কিং দেশে থাকতেই শুরু করেন তাহলে কানাডা আসার পর তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন, তাদের কাছ থেকে রেফারাল পাওয়ার সুযোগ তৈরি করতে পারবেন।
প্লিজ প্লিজ প্লিজ, নেটওয়ার্কিং করতে গিয়ে কাউকে অযথা বিরক্ত করবেন না। আর যাকে আপনি চিনেন না, জানেন না, তার সাথে নেটওয়ার্কিং করতে গিয়ে শুরুতেই তাকে একগাদা প্রশ্ন করে বিপদে ফেলবেন না। আমার মনে হয় একবার একটির বেশি প্রশ্ন করলে উত্তর না পাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। যদি সে রিপ্লাই দেয়, তারপরে আস্তে আস্তে আরো ইনফরমেশন জানার চেষ্টা করতে পারেন। আর কেউ যদি রিপ্লাই নাও দেয়, হতাশ হবার কিছু নেই। এখানে সবাই এতই ব্যস্ত থাকে যে, লিংকডইনে নিয়মিত ঢুকার সময় ম্যানেজ করতে পারে না!
টিপস ০৪: এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি
এতক্ষন যেগুলো বললাম, সেগুলো মূলত দেশে থাকতেই শুরু করে দেয়ার মত। এবার মনে করেন আপনি অলরেডি কানাডায় চলে এসেছেন। এখন কি করবেন? কিভাবে শুরু করবেন?
কানাডায় নিউকামারদের জন্য গভমেন্ট ফান্ডেড কিছু এজেন্সি আছে। তাদের কাজ হল নিউকামারদেরকে জব পাওয়ার জন্য সহযোগিতা করা। তবে সহযোগিতা মানে এই না যে ওরা আপনাকে জব পাইয়ে দেবে, ওদের কাজ হচ্ছে আপনাকে তৈরি করা, রেজুমি তৈরি করা থেকে শুরু করে ইন্ডাস্ট্রি নলেজ, কানাডিয়ান ওয়ার্কপ্লেস এনভায়রনমেন্ট, বেসিক এটিকেট, মক ইন্টারভিউ ইত্যাদি নানা ভাবে আপনাকে নলেজেবল করে তুলতে হেল্প করবে, যাতে আপনি নিজেই জব এর জন্য ১০০% প্রিপেয়ার্ড হয়ে যান। এসব অর্গানাইজেশন রেগুলার ইন্টারভালে কিছু ব্রিজিং প্রোগ্রাম পরিচালনা করে, সেখানে পার্টিসিপেট করার চেষ্টা করুন। সত্যি বলছি, এরা আপনাকে জব সার্চের ব্যাপারে খুঁটিনাটি অনেক কিছু শেখাবে, যা সত্যি বলতে কি, অনেক বছর ধরে কানাডা প্রবাসী আপনার অনেক কাছের লোকও বলতে পারবে না, বা তারা হয়ত বুঝবেও না যে আপনার এটা জানা প্রয়োজন!!!
আমি ব্যাংক জবের ব্যাপারে ফোকাসড ছিলাম, নিজেও ব্রিজিং প্রোগ্রামে পার্টিসিপেট করেছি, এবং আমি ১০০% স্যাটিসফায়েড! একটা উদাহরন দেই, আমি ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে দেখি যে আমার ইন্টারভিউ নিবে তার সাথে আমার আগেই পরিচয় হয়েছে, সেই ব্রিজিং প্রোগ্রামে! এবং পরিচিত হবার সুবাদে সেই ইন্টারভিউ আমার অসাধারন হয়েছিল!
এছাড়া আরেক ধরনের এজেন্সি আছে, যারা বিভিন্ন অরগানাইজেশনে কন্ট্রাকচুয়াল বেসিসে লোক নিয়োগে হেল্প করে। ওরা বিনিময়ে আপনার স্যালারি থেকে একটা অংশ প্রতিমাসে কেটে নিবে (ওরা আপানাকে যেই স্যালারি বলবে একচুয়ালি কোম্পানি এর চেয়ে বেশি পে করবে, তো যেই গ্যাপটা হবে সেটাই ওদের কমিশন) এবং আপনি যদি এমন সেক্টরের লোক হন যেখানে পাবলিকলি নিয়োগ খুব একটা হয় না, ইন্টারনাল নিয়োগ হয়, সেই সব জবের জন্য এই এজেন্সিগুলো খুব ভাল মাধ্যম! ব্যাংকিং-এও ব্যাক অফিসের অনেক জব এইভাবে পাওয়া যায়।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে উপরের বিষয়গুলো নিয়ে আপনাদের কিছু ইনফরমেশন শেয়ার করতে চেয়েছি। আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা যদি কারো কোন উপকারে আসে তবেই এই লেখার সার্থকতা!!!!
শুভরাত্রি!!!
Courtesy: Ayesha Parvin
FB Link : https://www.facebook.com/groups/camigbd/permalink/2038925879484711/